রাজন
ভট্টাচার্য ॥ গত বছরের ডিসেম্বর শুরু হওয়া প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনার
দ্বিতীয় ঢেউ চলছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় নতুন করে
আক্রান্তের কবলে আমেরিকা, স্পেন, ফ্রান্স, রাশিয়াসহ অনেক দেশ। আশঙ্কা করা
হচ্ছে- প্রথম দফার চেয়ে দ্বিতীয় অভিঘাত আরও কঠিন হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার
দেশগুলোতে এর প্রভাব ইতোমধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ,
কেরালা ও দিল্লীতে এখন করোনা সংক্রমণ উর্ধমুখী। পাকিস্তানে এই ভাইরাসের
দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। আমাদের দেশেও শীত মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে
আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় সরকারের
পক্ষ থেকে প্রস্তুতি নেয়া হলেও মাঠ পর্যায়ের চিত্র একেবারেই বেহাল। অর্থাৎ
প্রস্তুতির কোন প্রভাব মাঠে নেই কোথাও। সবার জন্য মাস্ক ব্যবহার সরকারের
পক্ষ থেকে বাধ্যতামূলক করার পর নতুন করে ঘোষণা দেয়া হয়েছে মাস্ক ছাড়া
সরকারী-বেসরকারী কোন সেবা নয়। মাস্ক ছাড়া সচিবালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু কেউ কি মানছে। না।
বিশেষজ্ঞরা
বলছেন, গণপরিবহন হলো ভাইরাস সংক্রমণের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মাধ্যম। অথচ
নৌ-সড়ক-রেলে স্বাস্থ্যবিধির কোন বালাই নেই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা
এখনই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়া হলে গণপরিবহন থেকে বেশি মানুষ
সংক্রমিত হতে পারে। নতুন করে করোনার এই ধাক্কায় বেসামাল করে তুলতে পারে সব
কিছু। বাড়তে পারে মৃত্যুও।
মস্তিষ্কের কাজ করার ক্ষমতা ৮.৫ শতাংশ
ধ্বংস করে ॥ করোনা নিয়ে দেশে খুব বেশি অবহেলা চললেও বিশ্বজুড়ে বাড়তি
সতর্কতার পাশাপাশি গবেষণা থেমে নেই। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষকরা
তাদের এক গবেষণায় দেখেছেন, সাম্প্রতিক মহামারীর জন্য দায়ী করোনাভাইরাস
মানুষের মস্তিষ্কের কাজ করার ক্ষমতা সাড়ে আট ভাগ ধ্বংস করে দেয় এবং বিভিন্ন
ধরনের মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করে। এ জীবাণু মানুষের মস্তিষ্কে সক্রিয়
থাকতে পারে অন্তত ১০ বছর।
এই গবেষকরা ৮৪ হাজারের বেশি করোনা
আক্রান্ত ও সুস্থ হওয়াদের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছেন। এতে দেখা গেছে, করোনা
থেকে কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর মুক্তি পেলেও এর প্রভাব রয়ে যাচ্ছে অধিকাংশের
শরীরে। অনেকেই বলেছেন, তারা অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছেন। এছাড়া শরীর ব্যথা,
ক্লান্তি, হৃদরোগসহ আরও উপসর্গ থাকছে। মস্তিষ্কের এ পরিস্থিতির তারা নামকরণ
করেছেন ‘ব্রেন ফগ’ হিসেবে। গবেষকরা আরও জানান, কোভিড-১৯ রোগ থেকে যারা
সেরে উঠছেন তাদের ইমিউনিটি (রোগ প্রতিরোধ) নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার কোন সুযোগ
নেই। কারণ শরীরের মধ্যে এ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা টেকে মাত্র কয়েক মাস। এরপরই
ওই ব্যক্তি আবার কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
স্বাস্থ্যবিধির হাল-হকিকত ॥ এই যখন পরিস্থিতি তখন করোনা প্রতিরোধে
আমাদের দেশের চিত্র একেবারেই ভয়াবহ বলা যেতে পারে। সম্প্রতি স্বাস্থ্যবিধি
না মেনে চলার সময় রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির একটি বাস সড়ক
পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের চোখে পড়ে। আসনের অতিরিক্ত যাত্রী উঠানোয়
বিআরটিসির গাড়ি চালককে সাময়িক বরখাস্ত এবং ডিপো ম্যানেজারকে কারণ দর্শানোর
নোটিস জারি করা হয়েছে বৃহস্পতিবার। বাসের চালক সোহরাব হোসেনকে সাময়িক
বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া বাসটি মোহাম্মদপুর ডিপোর অধীনে পরিচালিত হওয়ায়
কর্তব্যে অবহেলার জন্য ডিপো-ম্যানেজার নূর-এ-আলমকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বিআরটিসির বাসে আসনের অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন না করা এবং যাত্রী
ও বাস চালক এবং সহকারীকে মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
অথচ রাজধানীসহ সারাদেশে বাসে এক ভাগও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না।
দূরপাল্লার নামী দামী বেশিরভাগ পরিবহনে আসনপ্রতি যাত্রী ওঠানো হলেও লোকাল
সার্ভিসগুলোতে লোকে লোকারণ্য। আর রাজধানী শহরে বাসের চিত্র দেখলে চোখ কপালে
উঠবে। মার্কেটের মতোই যেন বাসে বাসে করোনার হাট। আসনপ্রতি যাত্রী। তারওপর
ভেতরে ঠাসা মানুষ। দাঁড়িয়ে দেদার যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। তেমনি মাথার ওপর
পড়ছে অন্য জনের নিঃশ্বাস। মাস্ক ছাড়া ৭০ ভাগের বেশি যাত্রী নিরুদ্বিগ্ন
হয়ে চলছেন। নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বাসে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি
মানা হচ্ছে না। ট্রেন ও লঞ্চে এখন স্বাস্থ্যবিধি একেবারেই ঢিলেঢালা।
কর্তৃপক্ষের যেমন নজরদারি কমেছে তেমনি যাত্রীরাও উদাসীন। অটোরিক্সা,
ট্যাক্সি থেকে শুরু করে উবারসহ এ্যাপভিত্তিক সকল প্রকার পরিবহনেও
স্বাস্থ্যবিধির দেখা মিলেনি।
দেশে গত আট মার্চ প্রথম করোনার রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে
গণপরিবহন বন্ধ করা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ৩১ মে থেকে থেকে দ্বার খুলে
সব রকমের গণপরিবহনের। বৃহস্পতিবার এক হাজার ৮৪৫ জনের দেহে করোনাভাইরাস
সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। যা গত দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ১০
সেপ্টেম্বর এর চেয়ে বেশি নতুন রোগী শনাক্তের খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য
অধিদফতর। সেদিন ১ হাজার ৮৯২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। বৃহস্পতিবার ২৪ ঘণ্টায়
করোনা সংক্রমণে প্রাণ গেছে আরও ১৩ জনের।
২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৭ হাজার ১১২টি। শনাক্তের হার ছিল ১০
দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর আগের দিন বুধবার নমুনা পরীক্ষা হয় ১৪ হাজার ৫২৪টি।
শনাক্তের হার ছিল ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংবাদ
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দেশে এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে মোট ৪
লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের দেহে। মৃত্যু হয়েছে ৬ হাজার ১৪০ জনের।
সরকারী
নির্দেশ উপেক্ষিত ॥ জানা গেছে, গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়া
প্রত্যাহার করে আগের ভাড়ায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহন পরিচালনার
নির্দেশনা দেয় সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী
যাত্রী, চালক ও সহকারী সবাইকে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ও পরিবহনে পর্যাপ্ত
সাবান-পানি অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখাসহ ট্রিপের শুরু এবং
শেষে যানবাহন জীবাণুমুক্ত রাখা।
কিন্তু রাজধানীর অধিকাংশ পরিবহনে স্বাস্থ্যবিধির এই ব্যবস্থাগুলো
মানতে দেখা যায় না। কিছু যাত্রীর মুখে মাস্ক পরা থাকলেও বাসচালক ও হেলপার
ছিল মাস্ক ছাড়া। এছাড়া সরকার নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ী বাস-মিনিবাসের
সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ ও ৭ টাকা। কিন্তু পরিবহনে তা আদায় করা হয়নি। দাঁড়িয়ে
যাত্রী পরিবহন নিষেধ থাকলে অনেক পরিবহন তা মানেনি। তবে আন্তঃজেলা বাস
সার্ভিসে ৬০ শতাংশ বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহার হলেও স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা
যায়নি।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, বাহন,
লাব্বাইক, প্রজাপতি পরিবহন, বনানী ট্রান্সপোর্ট, মিডওয়ে, তুরাগ, আট নম্বর,
সাত নম্বর, সিটি সার্ভিস সব ধরনের পরিবহনে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকরী
কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। যেন করোনাভাইরাসের কথা বেমালুম সবাই ভুলে গেছেন।
সায়েদাবাদ, মহাখালী, গাবতলী, ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেছে,
আন্তজেলা রুটের বাস চলছে কোন রকম স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়াই। তেমনি কমলাপুর
রেলস্টেশন ও সদরঘাটে ঢাকা নদী বন্দরের চিত্র একই। বিআরটিএ কর্মকর্তারা
বলছেন, আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত।
ঢাকা সড়ক
পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, প্রতিটি
বাস মালিকের স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু শহরের
অভ্যন্তরীণ রুটে এই নির্দেশনা কার্যকর করা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে মালিক
সমিতির পক্ষ থেকে কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে করোনা মোকাবেলায়।
এজন্য যাত্রীদের সচেতন হয়ে মাস্ক পরা নিশ্চিত করা জরুরী। এছাড়া কোন যাত্রীর
কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ এলে সেই পরিবহনের বিরুদ্ধে আইনগত
ব্যবস্থার পাশাপাশি সাংগঠনিক ব্যবস্থাও নেয়া হবে।’
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রতিরোধে করণীয় জানতে চাইলে, বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান
খান বলেন, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ বা
সেকেন্ড ওয়েভ দেখা দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে হাল না ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছে
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
সংস্থার মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম
গেব্রিয়েসাস এক অনলাইন সম্মেলনে বলেন, তিনি মহামারীর অবসাদ বুঝতে পেরেছেন,
যা মানুষ অনুভব করছেন। তবে কোন ভ্যাকসিন অথবা ওষুধ এখন পর্যন্ত না আসায় এ
ভাইরাস মোকাবেলায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন
তিনি। করোনা সংক্রমণের শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সময়োচিত
দিকনির্দেশনা এবং পরামর্শ দিয়ে আসছে; যা পরবর্তী সময়ে কার্যকর প্রমাণিত
হয়েছে বলেও মনে করেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
তিনি বলেন, অন্যান্য
দেশের মতো আমাদেরও দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় সচেতন হতে হবে। সবাই সচেতন না হলে
বিপদ বাড়বে। এজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন তিনি। বলেন,
অবশ্যই সবাইকে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা উচিত।
তিনি বলেন,
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন করে করোনার সংক্রমণ
বাড়ছে। সংক্রমণের দ্বিতীয় ধাক্কা ঠেকাতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে
বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। বিধি-নিষেধের প্রতিবাদে ইতালির বিভিন্ন শহরে
বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। বেলজিয়ামে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় ভাইরাসে আক্রান্ত
চিকিৎসকদেরও সেবা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। লাগামহীনভাবে করোনাভাইরাস
সংক্রমণ বৃদ্ধির ফলে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে স্পেন, ফ্রান্স, রাশিয়াসহ
বিভিন্ন দেশ। আশঙ্কা করা হচ্ছে- প্রথম দফার চেয়ে দ্বিতীয় অভিঘাত আরও কঠিন
হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
শীতে
করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির আট কারণ ॥ প্রশ্ন হলো শীতে কেন করোনার প্রকোপ বাড়তে
পারে। বিশ্ববিখ্যাত সাময়িকী ফোর্বসের ১০ অক্টোবর সংখ্যায় স্বাস্থ্য
বিশেষজ্ঞ ব্রুস ওয়াই লি শীতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ৮টি কারণ উল্লেখ করেছেন-
এগুলোর মধ্যে রয়েছে, কম আর্দ্রতা, কম তাপমাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য
পুনরায় চালু করা, বিদ্যালয় পুনরায় খুলে দেয়া, বাইরের জমায়েত ঘরের ভেতর
স্থানান্তর, ফ্লু এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের অসুখ, সাধারণ মানুষের
স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে অনীহা, বিভ্রান্তিকর প্রচার ও জাতীয় পরিকল্পনার
সমন্বয়হীনতা।
কেন করোনা সংক্রমণ বেড়েছে বা বাড়বে? ॥ বিশেষজ্ঞরা
বলছেন, শীতপ্রধান দেশে রুম হিটার ব্যবহার করার ফলে নাক এবং শ্বাসনালীর
প্রতিরোধকারী পর্দা (মিউকসা) শুষ্ক হয়ে যায়, এতে করোনাভাইরাস সহজেই দ্রুত
পর্দা ভেদ করতে পারে। স্বাভাবিক সময়ে এই পর্দা দ্রুত নাক এবং শ্বাসনালীতে
অনুপ্রবেশকারী যাবতীয় রোগজীবাণু, বালুকণা, ময়লা পরিষ্কার করে; কিন্তু
তাপমাত্রা কমে গেলে পরিষ্কার করার ক্ষমতা হ্রাস পায়।
এছাড়া শীতকালে ভাইরাসযুক্ত ছোট বালুকণা অধিক সময় বাতাসে ভেসে বেড়ায়
ফলে অধিক মানুষ সংক্রমিত হয়। শীতকালে সাধারণত অন্যান্য ঠাণ্ডাজনিত অসুখ হয়ে
থাকে; যেমন- ফ্লু, শ্বাসনালী-ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী রোগ, নানা ধরনের
শিশুরোগ। যখন অন্য একটি ভাইরাস সংক্রমিত করে তখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সহজ
হয়ে যায়; কারণ প্রথম ভাইরাসটি রোগীর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাটি দুর্বল করে
রাখে।
কার্যকর পদ্ধতি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ॥ বিগত ১০ মাসে বিশ্ববাসী যে
বাস্তব অভিজ্ঞতাটি পেয়েছে তা হলো করোনা প্রতিরোধে সব চাইতে কার্যকর পদ্ধতি
হলো যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। যে সমস্ত দেশ করোনা সংক্রমণের শুরু
থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেছে তারা ভাল ছিল এবং ভাল আছে। তাই আমাদের
সবাইকে নিজের স্বার্থে, পরিবারের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে করোনাভাইরাসের
ভয়াবহতা এবং রোগপরবর্তী ক্ষতিকর দিকগুলো মাথায় রেখে যথাযথভাবে
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
মাস্ক সামাজিক ভ্যাকসিন ॥ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাস্ক,
মাস্ক, মাস্ক : সবাইকে পরিষ্কার, নিয়মমাফিক মাস্ক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে
হবে। সরকারের পাশাপাশি সামাজিক সংগঠন, ব্যবসায়িক সংগঠনের বিনামূল্যে মাস্ক
বিতরণ কর্মসূচী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উদ্বুদ্ধকরণের পাশাপাশি
নজরদারির মাধ্যমে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে- মাস্কই এখন
সামাজিক ভ্যাকসিন।
পাশাপাশি শারীরিক দূরত্ব ৩ ফুট বজায় রাখতে হবে, হাত ভাল করে সাবান
পানি দিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী ধুতে হবে, ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে, শীতের সময়- ঘন ঘন
চা-পানি খেয়ে বা গড়গড়া করে নাক-মুখ ও শ্বাসনালী ভেজা রাখতে হবে ও ঘরবাড়ির
বায়ু চলাচল পর্যাপ্ত রাখতে হবে, করোনা পরীক্ষা পর্যাপ্ত রাখতে হবে। পজিটিভ
রোগীগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে। শিশু ও
বয়স্কদের ওপর বিশেষ নজর রাখতে হবে। করোনা উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে
ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
পাশাপাশি অন্যান্য শীতকালীন রোগ থেকে সতর্ক থাকতে হবে। অন্য রোগ
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়; তখন করোনাভাইরাস প্রাণঘাতী হয়ে
উঠে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাঃ লেলিন চৌধুরী করোনা রোধে দৃশ্যমান সতর্কতা
বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে বলেন, করোনাভাইরাস বিষয়ে অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে।
করোনা কিছু না, এমনি এমনি চলে যাবে- এ ধরনের ভুল অপপ্রচারে মানুষ বিভ্রান্ত
হয়ে অসতর্ক পথে পা বাড়ায়। গণমাধ্যমের গণসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান ও প্রচার
বৃদ্ধি করতে হবে। সমন্বয়- করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ বাস্তবায়নে
দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে নিবিড় সমন্বয় এবং বোঝাপড়া থাকতেই হবে।
প্রতিরোধে সকলের সচেতনতার পাশাপাশি সমন্বিত উদ্যোগের ওপরও জোর দেন তিনি।