ভাই সিঙ্গারা খাবেন ভাই? কলিজার সিঙ্গারা আছে, আলুর সিঙ্গারাও আছে। খেয়ে দেখতে পারেন ভাই খুব স্বুসাদু, একবার খেলে আবারও আসবেন আমার দোকানে।’ ঠিক এমনভাবেই রাজশাহীর চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রধান ফটকের সামনেই ক্রেতাদের ডাক দেন আকলিমা বেগম (৩৮)। রাস্তার পাশে ছোট চা-সিঙ্গাগার দোকানই তার জীবন সংগ্রামের একমাত্র অবলম্বন। জীবন ও জীবিকার বিষয়ে কিভাবে কাটে তার দিন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোর্ট চললেই পেট চলে ভাই, নাহলে গরীবের কস্ট দেখার কেউ নাই।’
ব্যবসায় জড়ানোর বিষয়ে জানতেই চাইলে স্বনির্ভর আকলিমা তার সংগ্রামী জীবনের গল্প তুলে ধরেন তিনি দৈনিক এই বাংলার প্রতিবেদকের কাছে।
বাড়িতে নিজের সংসারের কাজকর্ম সামলিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি স্বামী আহমদ আলীর (৫০) সঙ্গেই দোকানে কাটে তার পুরোটা সময়। এই দম্পতির চা-সিঙ্গাগার ব্যবসার যোগান দেয় আরও দুই কর্মচারি। দীর্ঘ ৭ বছর যাবৎ স্বামীকে নিয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে এভাবেই দোকান চালাচ্ছেন আকলিমা। তবে করোনাকালে তার ছোট্ট এই ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। তারপরও অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যেই কেটে যাচ্ছে আকলিমার এই সংগ্রামী জীবন।
তিনি বলেন, স্কুলের নাইট গার্ড বাবার হতভাগিনী মেয়ে তিনি। ছোটবেলাত্ইে আকলিমা বাবাহারা হন। তাই দাদ্রিতার কষাঘাতের কারণে আকলিমা পড়ালেখায় খুব বেশি এগুতে পারেনি। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ১৯ বছর বয়সে আজলিমা নগরীর তালাইমারী এলাকার মো. রতন আলীকে বিয়ে করেছিলেন। অনেকটা সুখে-শান্তিতেই কাটছিল রতন-আকলিমার দাম্পত্য জীবন। কয়েক বছরের সংসারে তাদের কোলজুড়ে দুই পুত্র সন্তানও এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে স্বামী রতন আলীর অকাল মৃত্যুতে আকলিমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
অকালে স্বামীর মৃত্যু হওয়ায় ১০ বছর স্থায়িত্ব সংসারের অর্জন ছোট দুই পুত্র সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন আকলিমা। শ্বশুড়বাড়ির অবস্থাও ছিল একেবারে শোচনীয়। উপায়ন্তর না পেয়ে আদরের দুই সন্তানকে নিয়ে ফিরে আসেন বাবাহারা মায়ের নগরীর লক্ষ্মীপুরের কাজীহাটার সেই গরীবালয়ে।
বাবাহারা আলকিমার জনমদুখিনী মায়ের ইচ্ছা থাকলেও মেয়ে আর নাতী আবির আলী ও ইমরান আলীর মুখে দুই মুঠো ভাত তুলে দেয়ার সাথ্যটুকুও ছিল না। উপায়ন্তর না পেয়ে ছোট দুই সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে আকলিমা মানুষের বাসা-বাড়ি ও ক্লিনিকে কাজ করা শুরু করেন। এভাবেই কাজ করতে করতে বছর পেরুতেই জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে ২০১২ সালে আহমদ আলীকে করেন আকলিমা। কিন্তু সমাজ বাস্তবতায় ছোট্ট দুই আদরের টুকরা ছেলে আবির-ইমরানকে রাখতে হয় তাদের দাদার বাড়িতে। দূর থেকেই মায়ের ভালোবাসায় বড় হতে থাকে আবির-ইমরান।আকলিমা ও তার স্বামী যৌথভাবে চালান চা-সিঙ্গারার দোকান ছেলেরা এখন কোথায় কী করছে জানতে চাইলে আকলিমা বলেন, ‘ অন্য স্বামীর ঘরে সংসার করায় ছেলে দুটোকে খুব বেশি সাপোর্ট দিতে পারিনি। শেখাতে পারিনি পড়ালেখাও। এখন তারা দাদার বাড়িতে আছে। বড় ছেলে আবিরের বয়স এখন ১৬। আর ছোট ছেলে ইমরানের বয়স ১৩। দুইজনই প্রাইমারি পর্যন্ত পড়ে দুইভাই একসাথে তালাইমারীতে ওয়ার্লিংয়ের কাজ করে।’ এসময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে আকলিমা বলেন, ‘ পরের সংসার করায় আদরের ছেলে দুটোকে খুব বেশি সাপোর্ট দিতে পারি না। তাদের জন্য সবসময় মন কাঁদে। মাঝেমধ্যে থাকতে না পেরে কাজের ফাঁকেই ছুটে যাই তাদের কাছে। ডিম কিংবা এটা-সেটা খাওয়ায়ে আসি। তাদের পোশাকও কিনে দিতে পারি না। মাঝেমধ্যে নিজের রোজগারের টাকা দিয়ে সেমাই খাওয়া ঈদে নতুন জামা কিনে দেই।’
স্বামীর সঙ্গে ব্যবসায় জড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে আকলিমা জানান, ৮ বছর আগে জমি রেজিস্ট্রির একটি বিষয়ে মায়ের সঙ্গে ডিসি অফিসে গিয়েছিলেন তিনি। ওই দিন ডিসি অফিস চত্বরের চা দোকানী আহমদ আলীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এই পরিচায় থেকেই পারিবারিকভাবে আকলিমা এই চা বিক্রেতার সঙ্গে আবদ্ধ হন বিবাহ বন্ধনে। আকলিমা বলেন, ‘কয়েক বছর আগে ডিসি অফিস থেকে তার চায়ের দোকানটি তুলে দেয়া হয়। এরপরই ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনেই স্বামীর সঙ্গে নতুনভাবে চা-সিঙ্গাগার ব্যবসা শুরু করি।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আকলিমা বলেন, ‘এই স্বামীর সংসারে আসার পর বছর ছয়েক আগে আমার তৃতীয় ছেলে রূপস আলীর (৬) জন্ম হয়। ৫ মাসের ছেলেকে নিয়ে স্বামীর এই ব্যবসায় হাল ধরি। ছোট্ট ছেলেকে সারাদিন কোর্টের বারান্দায় শুইয়ে রেখে তখন ব্যবসা করেছি। এখনও চালিয়ে যাচ্ছি ব্যবসার এই সংগ্রাম।’
আকলিমা বলেন, ‘অভাবের এই দোকানে শহিদুল (৪০) ও তার ছেলে জাহিদকে (১৩) কাজে সহযোগিতার জন্য রেখেছি। তাদের প্রতিদিন সাড়ে ৪০০ টাকা মাইনা দিতে হয়। করোনার আগে দিনে গড়ে ৩-৪ হাজার টাকা বিক্রি করে দেড়-দুই হাজার টাকা আয় হতো। কিন্তু এখন কমে গেছে।’
স্বামীকে দেখিয়ে আক্ষেপের স্বরে আকলিমা বলেন, ‘জীবনটাই আমার সংগ্রামের। স্বামী অনেকটা বৃদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও বয়স্কভাতা পায় না। ও যদি বষস্ক ভাতা পেতো তাহলে জীবনটা চালাতে একটু সহজ হতো।’