করোনাকালে বাঘ গণনায় উৎসাহী বন অধিদপ্তর!
নিজস্ব প্রতিবেদক
সর্বশেষ ২০১৮ সালের শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘ রয়েছে ১১৪টি ছবি:
বাঘ গণনায় গৃহীত সর্বশেষ প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে ২০১৮ সালে। দুই বছর পেরোতে না পেরোতেই বন অধিদপ্তর এ নিয়ে আবারো একটি প্রকল্প হাতে নিতে চাইছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে আগামী বছর অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলনে প্রাণীটি সংরক্ষণে বাংলাদেশের সাফল্যের চিত্র তুলে ধরার কথা বলছে অধিদপ্তর। যদিও করোনাকালে এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে আপত্তি উঠেছে সরকারের নীতিকৌশল নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা কমিশন থেকেও।
বিশ্বব্যাপী বাঘ এখন বিপন্ন। প্রাণীটির অস্তিত্ব সুরক্ষায় গৃহীত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দেশই বাঘশুমারি বা গণনার উদ্যোগ নেয়। প্রতিবেশী ভারতে বাঘের সংখ্যা নিরূপণে প্রথম শুমারি হয় ২০০৬ সালে। এরপর ২০১০ ও ২০১৪ সালে দুই দফায় জরিপ চালায় দেশটি। সেখানে সর্বশেষ শুমারি শেষ হয় ২০১৮ সালে। ওই বছরের শুমারির তথ্য নিয়েই আসন্ন আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলনে যোগ দিতে যাচ্ছে ভারত। দেশটির স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এসব শুমারিতে পাওয়া তথ্য ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভারত এখন বাঘের সংখ্যা বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বিপরীত চিত্র বাংলাদেশে। এখানে নিয়মিত বিরতিতে শুমারি হলেও বাঘের সংখ্যা বাড়েনি।
আগের শুমারির অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে কাজে না লাগিয়েই বন অধিদপ্তরের এ নিয়ে নতুন করে উদ্যোগ নেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশনও। সম্প্রতি এ নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই প্রকল্পের বিভিন্ন দিক নিয়ে আপত্তি ওঠে। কমিশনের সদস্য (সচিব) রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বলা হয়, নতুন ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) বাঘশুমারী নিয়ে আগের বিভিন্ন প্রকল্পের ফলাফল সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়নি। এছাড়া আগের বিভিন্ন প্রকল্পের সঙ্গে এর ধারাবাহিকতা নিয়েও এ সময় প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়।
এ সময় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমানে করোনা নিয়ন্ত্রণকেই সর্বোচ্চ জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ মুহূর্তে বাঘ গণনার চেয়ে আয়বর্ধক প্রকল্প হাতে নেয়াটাই বেশি সমীচীন হবে। তবে জরুরি মনে হলে বাঘ গণনা ও আন্তর্জাতিক বাঘ সম্মেলনে অংশগ্রহণকে বিশেষ কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করে এগুলোর ব্যয়কে পরিচালন বাজেটের আওতায় নিয়ে আসা যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, শুমারির সুফল পেতে হলে গণনায় উঠে আসা তথ্য ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো খুবই জরুরি। তা না হলে এটি পর্যবসিত হয় নিষ্ফল প্রয়াসে। বাস্তবসম্মত, কার্যকর ও যথাযথ উদ্যোগ নেয়া না হলে কেবল গণনা করে বাঘের সংখ্যা বাড়ানো অসম্ভব।
এ বিষয়ে বাঘ বিশেষজ্ঞ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান জানান, জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে বাঘ সংরক্ষণের মতো প্রকল্প খুবই প্রয়োজনীয়। এ ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে বাঘ সংরক্ষণে অনেক উদ্যেগ নেয়া হয়। সেগুলো বনাঞ্চলের অন্যান্য বাস্তুতন্ত্র রক্ষায়ও খুবই জরুরি। সে বিবেচনায় এ ধরনের প্রকল্প অবশ্যই প্রয়োজনীয়। তবে এসব প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ অপচয়ের সুযোগ যাতে তৈরি না হয়, সে বিষয়টিতেও লক্ষ রাখতে হয়। অন্যথায় এসব প্রকল্পের কোনো সুফল পাওয়া যায় না।
গণনার উদ্যোগ নিয়ে বন অধিদপ্তর বলছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে টিকিয়ে রাখতে দরকার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ, পর্যবেক্ষণ ও আবাসস্থল সংরক্ষণ। সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাঘশুমারি সম্পন্ন হয়। এর ভিত্তিতে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ আছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়। বাঘ সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে অধিদপ্তর বর্তমানে বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান (২০১৮–২৭) বাস্তবায়ন করছে। সে পরিকল্পনায় সুন্দরবনের সব এলাকায় প্রাণীটির উপস্থিতি নিশ্চিত করা, বাঘ ও মানুষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব কমানো এবং বাঘের আবাসস্থলের উন্নয়ন ও আধুনিক পরিবীক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের কথা বলা রয়েছে। পাশাপাশি বাঘ সংরক্ষণে বন অধিদপ্তরের কর্মীদের সার্বিক সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথাও এতে বলা রয়েছে। এছাড়া ২০২২ সালে অনুষ্ঠেয় বাঘ সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রাণীটি সংরক্ষণে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরার জন্যও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এটি বাস্তবায়নের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৪২ কোটি ২ লাখ টাকা।
বৈঠকে প্রকল্পের আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে আপত্তি ওঠে। এ সময় বলা হয়, ডিপিপিতে প্রস্তাবিত অধিকাংশ কার্যক্রম বন অধিদপ্তরের নিয়মিত কাজ। বন বিভাগের রাজস্ব বা অপারেশনাল বাজেট থেকেই এগুলোর নির্বাহ করা হয়।
এ সময় আগামী বছর রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠেয় বাঘ সম্মেলন নিয়েও আলোচনা হয়। এ সময় সম্মেলনে অংশগ্রহণের যাবতীয় ব্যয় রাজস্ব বাজেট থেকে মেটানোই সমীচীন হবে বলে অভিমত উঠে আসে। এ বিষয়ে কমিশনের বক্তব্য হলো, এ ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব রাজস্ব বাজেট বরাদ্দ থাকে।
প্রস্তাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠানোর কথা বলা হয়। তবে পরামর্শকনির্ভর হওয়ায় এ প্রশিক্ষণের প্রস্তাব অযৌক্তিক বলে বৈঠকে উপস্থিত অর্থ বিভাগের প্রতিনিধি আপত্তি জানান। আপত্তিতে বলা হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে পরামর্শকের মাধ্যমে। অন্যদিকে বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এতে কখন, কীভাবে, কী অবদান রাখবেন; সে বিষয়ে এখানে কোনো স্পষ্ট তথ্য দেয়া হয়নি।
প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী বৈঠকে জানান, প্রকল্পটি প্রাথমিক পর্যায়ে পরামর্শকদের মাধ্যমে করা হলেও স্থানীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের পরবর্তী কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে। এ কারণে তাদের প্রশিক্ষণ খুবই জরুরি। জিপিএস ট্র্যাকিং ও ক্যামেরা স্থাপন, তথ্য সংগ্রহ, মনিটরিং ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল ও থাইল্যান্ড বাঘ সংরক্ষণ বা শুমারিতে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছে। নিকটবর্তী দেশ ভারতেরও এ বিষয়ে সফলতার গল্প রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের বিদেশে প্রশিক্ষণ বন বিভাগের কার্যক্রমকে আরো বেগবান করবে।
বৈঠকে ডিপিপির অন্যান্য বিষয় নিয়েও আপত্তি তোলা হয়। এ সময় বলা হয়, এতে জনবল কাঠামো সুবিন্যস্ত নয়। পরামর্শক বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে মোট ব্যয়ের প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ, যা অনেক বেশি। পরামর্শকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয় যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া জনবলবিষয়ক প্রস্তাব না থাকায় এ সংশ্লিষ্ট সব ধরনের সরবরাহ ও সেবা কার্যক্রমও (যেমন ভ্রমণ, পোশাক, জলযান, পরিচালন ব্যয়, টেলিফোন বিল, মেরামত ইত্যাদি) প্রকল্প থেকে বাদ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি বণিক বার্তাকে বলেন, এ ধরনের প্রকল্প খুবই প্রয়োজনীয়। কিন্তু বাঘ রক্ষায় কোনো প্রকল্প নিতে চাইলে অনেক জায়গা থেকে আপত্তি ওঠে। বিষয়টি ঠিক নয়। আসন্ন বাঘ সম্মেলনেও প্রাণীটি রক্ষায় আমাদের উদ্যোগ তুলে ধরার বিষয় রয়েছে। সেসব কারণে প্রকল্পটি যৌক্তিক।