র্যাবের
অভিযানে বহুল আলোচিত কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ডসহ একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনার
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রওশন ওরফে আলী ওরফে উদয় মন্ডল গ্রেপ্তার হয়েছেন।
গতকাল বুধবার মধ্যরাতে রাজশাহী মহানগরীর শাহমখদুম থানার ভারালীপাড়া থেকে
তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৫।গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সালে কুষ্টিয়া
জেলার দৌলতপুর উপজেলায় একটি সভা চলাকালীন প্রকাশ্য দিবালোকে দুর্বৃত্তদের
অতর্কিত গুলি বর্ষণে কাজী আরেফসহ পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দৌলতপুর থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। ওই মামলায় ২৯ জনকে
আসামি করে চার্জশীট দাখিল করা হয়।সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ২০০৪ সালের ৩০
আগস্ট কুষ্টিয়া জেলার জেলা দায়রা জজ আদালত ১০ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং
১২ জন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন।আসামিরা
নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। ২০০৮ সালের ৫ আগস্ট
উচ্চ আদালত ৯ জন আসামির ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন এবং বাকি ১৩ জনকে খালাস
প্রদান করেন। তন্মধ্যে ২০১৬ সালের ৮ জানুয়ারি তিনজন আসামির ফাঁসির আদেশ
কার্যকর করা হয়। এ ছাড়া একজন আসামি কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন।আজ
দুপুরে রাজধানীর র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা
জানান র্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি
বলেন, ওই মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত অপর পাঁচ আসামি দীর্ঘদিন যাবৎ পলাতক
রয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে র্যাব উদ্যোগী হয়ে গোয়েন্দা
নজরদারি অব্যাহত রাখে।
এরই ধারাবাহিকতায় র্যাব-৫ এর অভিযানে গতকাল
মধ্যরাতে রাজশাহী মহানগরীর শাহমখদুম থানার ভারালীপাড়া হতে মো. রওশন ওরফে
আলী ওরফে উদয় মন্ডল (৫৭) কে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কমান্ডার
খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তারকৃত রওশনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কাজী
আরেফ হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করেছে। এ ছাড়া সে আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ড; সহিংসতা ও ডাকাতির সংশিষ্টতার তথ্য প্রদান করেছে। র্যাব
জানায়, গ্রেপ্তারকৃত মো. রওশন ওরফে উদয় মন্ডল স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে
পড়াশোনা শুরু করে রাজবাড়ীস্থ একটি কলেজ হতে বিএ পাশ করে। অতঃপর ১৯৯২ সাল
হতে সীমান্তবর্তী চোরাচালান, হাট ইজারাসহ বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি
কাজে সম্পৃক্ত হয়। এ সমস্ত কাজে সে এলাকায় সন্ত্রাসী চক্র গড়ে তোলে। যাদের
সহযোগিতায় সে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করতো। তার সঙ্গে চরমন্থী দলের সখ্যতাও
তৈরি হয়।গ্রেপ্তারকৃত ১৯৯৮ সালের পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকটি হত্যা ও
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হয়। এ সময় মাঝে মধ্যে সে গা ঢাকা দিতে
রাজশাহীতে অস্থায়ীভাবে অবস্থান শুরু করে। র্যাব আরও জানায়,
গ্রেপ্তারকৃত রওশন রাজশাহীতে পরিচয় গোপন করতে ‘আলী’ নামে পরিচয় দিতো। এ
ছাড়া রাজশাহীতে সে তার আদি নিবাস ‘গাজীপুর’ বলে সবাইকে জানাত। প্রাথমিক
পর্যায়ে সে একটি গরুর খামার স্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে সে জমি কেনা-বেচার
ব্যবসায় যুক্ত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে সে রাজশাহীতে স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলে।রাজশাহীতে
অবস্থানকালে সে ‘উদয় মন্ডল’ নামে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে। তবে সে
নিজ এলাকায় নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। প্রভাব বিস্তার ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম
চালাতে সে মাঝে মধ্যেই নিজ এলাকায় গমন করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ
করেই আবারও গা ঢাকা দিতো। কাজী আরেফ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সে জানায়,
উক্ত হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ ছাড়াও সমন্বয় এবং পরিকল্পনার
সঙ্গে যুক্ত ছিল। এ ছাড়া সে চেয়ারম্যান বাকী ও স্থানীয় আমজাদ হত্যাকাণ্ডে
অংশগ্রহণ ও পরিকল্পনার সঙ্গেও তার সংশ্লিষ্টতা ছিল। তার নামে ২০০৫ সালে
গাংনীতে একটি ডাকাতি মামলাও রয়েছে বলে জানা যায়। গ্রেপ্তারকৃত মো.
রওশন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (কাজীপুর) চেয়ারম্যান বাকী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে
তার সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রদান করেছে। সে জানায়, ১৯৯৯ সালের ১৩ এপ্রিলে
চেয়ারম্যান আব্দুল বাকীকে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া মহাসড়কের তেরাইল কলেজ সংলগ্ন
এলাকায় প্রকাশ্যে দিবালোকে গুলি করে হত্যা করে।এই ঘটনায় চেয়ারম্যান
বাকী তার ছেলে আবদুল্লাহ বাশারকে নিয়ে মোটরসাইকেল যোগে যাওয়ার পথে
গ্রেপ্তারকৃত রওশন ও তার সহযোগী অন্য একটি মোটরসাইকেলে তাদের পথ অবরোধ করে।
অতঃপর আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে প্রথমে চেয়ারম্যান বাকীকে এবং পরবর্তী সময়ে
চেয়ারম্যানের ছেলে আবদুল্লাহ বাশারকে গুলি করে। ঘটনাস্থলে চেয়ারম্যান বাকী
নিহত হন এবং তার ছেলে আবদুল্লাহ গুরুতর আহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য
শেষে গ্রেপ্তারকৃত রওশনকে হত্যার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।এ
ছাড়া গ্রেপ্তারকৃত মো. রওশন ২০০০ সালে ২১ জুন তারিখে স্কুল শিক্ষক আমজাদ
হত্যা মামলার ১নং চার্জশীটভুক্ত পলাতক আসামি। সেই হত্যাকাণ্ডেও সে তার
সহযোগীসহ পথিমধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে প্রকাশ্যে দিবালোকে ওই
স্কুলশিক্ষককে গুলি করে হত্যা করে।কাজী আরেফ, চেয়ারম্যান বাকী,
স্কুল শিক্ষক আমজাদ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল এমন
তথ্য পাওয়া গেছে বলেও জানিয়েছে র্যাব।