কোরআনের বর্ণনায় কারুনের পরিণতি
ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক
আল্লাহ
তাআলা বলেন, ‘অতঃপর আমি তাকে (কারুন) ও তার প্রাসাদকে মাটিতে ধসিয়ে দিলাম।
তার স্বপক্ষে এমন কোনো দল ছিল না যে আল্লাহর শাস্তির থেকে তাকে সাহায্য
করতে পারত এবং সে নিজেও আত্মরক্ষায় সক্ষম ছিল না।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ৮১)উল্লিখিত আয়াতের পূর্বাপর কয়েকটি আয়াত মিসরীয় প্রভাব ও বিত্তের প্রতীক কারুনসম্পর্কিত। আল্লাহর আজাবে সে সহায়-সম্পদসহ ধ্বংস হয়েছিল।কারুনের পরিচয় : বাইবেল ও তালমুদে কারুনকে কোরহ (কড়ত্ধয) বলে উল্লেখ করা
হয়েছে। সে ছিল মুসার (আ.)-এর চাচাতো ভাই। বাইবেলের যাত্রাপুস্তকে
(৬:১৮-২১) যে বংশধারা বর্ণনা করা হয়েছে, তার দৃষ্টিতে বলা যায়, মুসা ও
কারুনের পিতা উভয়ই ছিল পরস্পর সহোদর ভাই। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাসের (রা.)
মতে, সে ছিল মুসার (আ.)-এর চাচাতো ভাই। মুসা (আ.) বনি ইসরাঈলের এক অঞ্চলের
নেতৃত্ব দিতেন এবং কারুন অন্য অঞ্চলের নেতৃত্ব দিত। (তাফসিরে তাবারি)কারুনের জাগতিক প্রজ্ঞা : পবিত্র কোরআনে (সুরা কাসাস, আয়াত : ৭৮) তাকে
যে ‘ইলম’ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা দ্বারা অর্থনৈতিক কলাকৌশল তথা
ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ইত্যাদি অর্থ হতে পারে। (তাফসিরে জাকারিয়া)আতা (রহ.) বলেন, কারুন নবী ইউসুফ (আ.)-এর একটি বিরাট ভূগর্ভস্থ ধনভাণ্ডার লাভ করেছিল। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন)কারুনের সম্পদের পরিমাণ : তার সম্পদ ছিল অঢেল। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
‘কারুন ছিল মুসার সম্প্রদায়ভুক্ত; কিন্তু সে তাদের প্রতি ঔদ্ধত্য প্রকাশ
করেছিল। আমি তাকে দান করেছিলাম এমন ধনভাণ্ডার যার চাবিগুলো বহন করা একদল
বলবান লোকের পক্ষেও কষ্টসাধ্য ছিল।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ৭৬)কারুনের আবাসভূমি : কোরআনে ‘কারুন ও তার নিবাস’ বলতে কারুনের বসতভূমি ও
শাসিত অঞ্চলের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওই স্থান কোথায়, যেখানে আল্লাহ
কারুনকে তার সম্পদসহ মাটিতে ধসিয়ে দিয়েছিলেন? কোনো কোনো তাফসিরকার ঘটনাটিকে
মুসা (আ.) ও বনি ইসরাঈলের মিসর ত্যাগের পরবর্তী ‘তিহ’ এলাকায় সংঘঠিত হয়েছে
বলে উল্লেখ করেছেন। কেউ কেউ ঘটনাটি ইরাকের নিনওয়া অঞ্চলে ঘটে থাকবে বলে মত
প্রকাশ করেছেন। তবে কারুন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের বর্ণনা সামনে রাখলে
মুসার (আ.) সঙ্গে তার মিসর ত্যাগের প্রশ্ন-ই আসে না।কারুনের বিশ্বাসঘাতকতা : কারুন বনি ইসরাঈলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরও
ফিরাউনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিল এবং তাদের একজনে পরিণত হয়েছিল। ইরশাদ হয়েছে,
‘আমি মুসাকে আমার নিদর্শনগুলো এবং সুস্পষ্ট যুক্তি সহকারে ফিরাউন, হামান ও
কারুনের কাছে পাঠালাম। কিন্তু তারা বলল, এ একজন জাদুকর, ডাহা মিথ্যুক।’
(মুমিন, আয়াত : ২৩-২৪)এ থেকে পরিষ্কার হয়ে যায়, কারুন নিজ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং
বনি ইসরাঈলকে শিকড়সহ উপড়ে ফেলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। আর এ জাতীয়
বিশ্বাসঘাতকতার বদৌলতে ফিরাউনের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে সে এমন গুরুত্বপূর্ণ
মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়েছিলকারুন হ্রদ : মিসরের ফায়ুম শহরে ‘বুহাইরা কারুন’ তথা ‘কারুন হ্রদ’ নামে
একটি স্থান রয়েছে। রাজধানী কায়রো থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে প্রায় ১২০
কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখন এটি ‘বিরকেত কারুন’ নামে টিকে আছে। যার আয়তন
প্রায় ২০২ বর্গ কিলোমিটার বা ৭৮ বর্গ মাইল। জনশ্রুতি আছে, মুসা (আ.)-এর
চাচাতো ভাই কারুনের নামানুসারে এই স্থানের নামকরণ করা হয়েছে।কারুন যেভাবে ধ্বংস ডেকে আনে : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা
করেছেন, একদিন কারুন একজন ব্যভিচারী নারীকে এ শর্তে কিছু অর্থ দিল যে সে
জনতার সামনে প্রকাশ্যে বলবে, হে মুসা, তুমি আমার সঙ্গে ব্যভিচার করেছ! মুসা
(আ.) আঁতকে উঠলেন এবং ওই নারীকে ডেকে পাঠালেন। ওই নারী ঘটনা অস্বীকার করে
এবং কারুন তাকে অর্থের বিনিময়ে এরূপ মিথ্যা অপবাদে প্ররোচিত করেছে—এ কথা
জানিয়ে দেয়। তখন মুসা (আ.) সিজদায় পড়ে কান্না করতে লাগলেন। আল্লাহ মুসার
(আ.) কাছে এ মর্মে ওহি প্রেরণ করলেন যে ভূমিকে নির্দেশ মান্য করতে বলা
হয়েছে। মুসা (আ.) বলেন, ’হে ভূমি, তাকে গ্রাস কোরো।’ এতে তার হাঁটু পর্যন্ত
ধসে গেল। তিনি আবার বলেন, হে ভূমি, তাকে গ্রাস কোরো!’ এতে তার কোমর
পর্যন্ত প্রোথিত হয়ে গেল। এবার আবার বলেন, হে ভূমি, তাকে ধরো। তাতে তার বুক
পর্যন্ত দেবে গেল। সে বাঁচার জন্য সাহায্য কামনা করল। মুসা (আ.) বলেন, হে
ভূমি, তাকে ধরো। তারপর সে সম্পূর্ণ তলিয়ে গেল। (তাফসিরে তাবারি)