রাজধানীর শান্তিনগরের বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ৪৯টি
ভুয়া মামলা দায়েরের নেপথ্যে রাজারবাগ পীর সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার ঘটনায়
বিস্ময় প্রকাশ করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পীর সাহেবের কাণ্ড দেখেন! একটা পীরের
সিন্ডিকেট কীভাবে ধর্মে দোহাই দিয়ে নিরীহ মানুষকে নির্যাতন করে। নিরীহ
মানুষকে কীভাবে হয়রানি করছে। জায়গা জমি দখলের জন্য পীর সাহেবরা
অনুসারী-মুরিদ দিয়ে কী করে দেখেন! যেখানে একজন মানুষকে একটা মামলা দিলেই
জীবন শেষ হয়ে যায়, সেখানে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে এত মামলা! এটা তো সিরিয়াস
ব্যাপার।’রাজধানীর শান্তিনগরের একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ৪৯টি ‘ভুয়া’
মামলা নিয়ে সিআইডি'র দেওয়া প্রতিবেদন দেখে রোববার বিচারপতি এম ইনায়েতুর
রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।আদালত বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবেন বলে জানান। পরে মামলাটির শুনানি এক
সপ্তাহের মুলতবি করেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট এমাদুল
হক বসির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিপুল বাগমার।সিআইডির দাখিল করা প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘একরামুল আহসান কাঞ্চনের তিন ভাই ও
এক বোন। ১৯৯৫ সালে তার বাবা ডা. আনোয়ারুল্লাহ মারা যান। রাজারবাগ দরবার
শরিফের পেছনে ৩ শতাংশ জমির ওপর তিনতলা পৈতৃক বাড়ি তাদের। বাবার মৃত্যুর পর
কাঞ্চনের বড় ভাই আক্তর-ই-কামাল, মা কোমরের নেহার ও বোন ফাতেমা আক্তার পীর
দিল্লুর রহমানের মুরিদ হন। কিন্তু রিট আবেদনকারী ও তার অপর ভাই ডা. কামরুল
আহসান বাদলকে বিভিন্নভাবে প্ররোচিত করেও ওই পীরের মুরিদ করা যায়নি।
এরমধ্যেই একরামুল আহসান কাঞ্চনের মা, ভাই ও বোনের কাছ থেকে তাদের পৈতৃক
জমির অধিকাংশই পীরের দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করা হয়। আর একরামুল
আহসান কাঞ্চন ও তার ভাইয়ের অংশটুকু পীর এবং তার দরবার শরিফের নামে
হস্তান্তর করার জন্য পীর দিল্লুর এবং তার অনুসারীরা বিভিন্নভাবে চাপ দেয়।
কিন্তু সম্পত্তি হস্তান্তর না করায় পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীদের
সঙ্গে একরামুল আহসান কাঞ্চনের শত্রুতা সৃষ্টি হয়। শত্রুতার কারণেই
কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় হয়রানিমূলক মামলা
দায়ের করা হয়।’সিআইডির এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ঢাকার
বাইরে বিভিন্ন জেলায় সর্বমোট ৪৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এরমধ্যে জিআর
মামলা ২৩টি ও সিআর মামলা ২৬টি। ইতোমধ্যে জিআর ১৫টি মামলা ও সিআর ২০টি
মামলায় কাঞ্চন আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন। বর্তমানে ১৪টি মামলা আদালতে
বিচারাধীন। যার মধ্যে ৮টি জিআর ও ৬টি সিআর মামলা রয়েছে। ’‘অধিকাংশ মামলার নথিপত্র সংগ্রহের পর পর্যালোচনা করে দেখা যায়,
আবেদনকারীর বিরুদ্ধে একাধিক মানবপাচার, নারী নির্যাতন, বিস্ফোরক দ্রব্য
আইন, হত্যাচেষ্টা মামলাসহ প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, ডাকাতির প্রস্তুতিসহ
বিভিন্ন ধর্তব্য ও অধর্তব্য ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাগুলো
সম্পর্কে প্রকাশ্য ও গোপনে অনুসন্ধান করে জানা যায়, অধিকাংশ মামলার বাদী,
সাক্ষী, ভুক্তভোগীরা কোনো না কোনোভাবে রাজারবাগ দরবার শরিফ ও ওই দরবার
শরিফের পীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।’এর আগে, গত ১৪ জুন রাজধানীর শান্তিনগরের বাসিন্দা একরামুল আহসান
কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ৪৯টি ‘ভুয়া’ মামলার বাদীদের খুঁজে বের করতে পুলিশের
অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ভুয়া মামলা
ঠেকাতে এখন থেকে থানায় বা আদালতে কারও বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে বাদী বা
অভিযোগকারীর জাতীয় পরিচয়পত্রের অনুলিপি বাধ্যতামূলক দাখিল করতে হবে বলেও
নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট।গত ৭ জুন নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, মানবপাচারসহ বিভিন্ন
অভিযোগে ৪৯টি মামলা মাথায় নিয়ে রিট করেন রাজধানীর শান্তিনগরের বাসিন্দা
একরামুল আহসান কাঞ্চন। রিটে গায়েবি মামলার বাদীদের খুঁজে বের করতে সিআইডির
প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়। একইসঙ্গে মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একরামুল আহসান
কাঞ্চন রিটে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। কাঞ্চনের পক্ষে অ্যাডভোকেট এমাদুল হক
বসির এ রিট দায়ের করেন।স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজি, অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক (এসবি),
অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক (সিআিইড), র্যাব মহাপরিচালক, ঢাকার পুলিশ
কমিশনারসহ ৪০ জনকে বিবাদী করা হয়।অ্যাডভোকেট এমাদুল হক বসির বলেন, রাজধানীর শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা
একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় নারী নির্যাতন,
ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, মানবপাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৪৯টি মামলা দায়ের হয়। এসব
মামলায় তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়। কিন্তু একটি মামলারও বাদী খুঁজে
পাওয়া যায়নি। এ বিবেচনায় তিনি অনেক মামলাতে খালাস পেয়েছেন। তারপরও তার
বিরুদ্ধে এভাবে গায়েবি মামলা দিয়ে হয়রানি করায় তার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত
হয়েছে। এসব মামলায় একরামুল আহসান ১ হাজার ৪৬৫ দিন জেল খেটেছেন বলেও রিটে
উল্লেখ করা হয়েছে।রিটকারী একরামুল আহসান কাঞ্চন বলেন, হত্যা, ধর্ষণ,
চুরি-ছিনতাই-চাঁদাবাজি ও মানবপাচারের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধের অভিযোগে আমার
বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এমন কোনো অভিযোগ নেই আমার ওপর প্রয়োগ করা
হয়নি। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব মামলার বাদীদের খুঁজে পাইনি। এসব মামলায়
দীর্ঘদিন জেলও খেটেছি। এর মধ্যে অনেক মামলায় আদালত বাদী খুঁজে না পাওয়ায়
খালাস পেয়েছি।