কথায় বলে, মাছে-ভাতে বাঙালি। এবার ‘হিসাব’ও বলছে, ভাতের সঙ্গে মাছ না হলে বাঙালির চলে না!
কথায় বলে, মাছে-ভাতে বাঙালি। এবার ‘হিসাব’ও বলছে, ভাতের সঙ্গে মাছ না হলে বাঙালির চলে না! বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষ গড়পড়তায় দিনে যে পরিমাণ মাছ খায়, বাংলাদেশের মানুষ খায় তার চেয়ে চার গুণ বেশি।সারা দেশের বেশির ভাগ নদ-নদী যেখানে দিন দিন দখল-দূষণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে, সে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষ মাছ খাওয়ার ‘বিলাসিতা’ করতে পারছে মূলত চাষের মাছের কারণে। দেশের বাজারে এখন প্রতিদিন মিঠাপানির যত মাছ বিক্রি হয়, তার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মাছের জোগান আসে চাষ থেকে। এর মধ্যে রুই, পাঙাশ ও তেলাপিয়ার দাপট সবচেয়ে বেশি। তুলনামূলক নদ-নদীর মাছের চেয়ে চাষের এসব মাছের দামও গড়ে অর্ধেকের মতো।বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষ গড়পড়তা দিনে ১৬ গ্রাম করে মাছ খায়, বাংলাদেশের মানুষ খায় ৬৩ গ্রাম। এসব মাছের বেশির ভাগই মিঠাপানির। বাংলাদেশের মানুষ দিন যে পরিমাণে প্রাণিজ আমিষ খায়, তার ৬০ শতাংশ আসে মাছ থেকে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, গত তিন যুগে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন ছয় গুণ বেড়েছে। একই তথ্য দিচ্ছে বাংলাদেশের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও।যেভাবে ‘মাছবিপ্লবের’ সূচনাআশির দশকের শুরুতেও দেশের নদ-নদী, বিল, হাওরগুলোতে মাছ কমে আসছিল। জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাছের চাষও খুব একটা বাড়ছিল না। এ অবস্থার বদল ঘটে আশির দশকের মাঝামাঝি। উন্নত দেশগুলোতে চাষের মাছের জনপ্রিয়তা শুরুর কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশে রুই, পাঙাশ ও তেলাপিয়ার মতো দ্রুত বৃদ্ধি পায়, এমন মাছের চাষ শুরু হয়। নব্বইয়ের দশক থেকে দেশে পুকুরে মাছ চাষে রীতিমতো বিপ্লবের সূচনা হয়।শুরু থেকেই চাষের মাছের দাম নদ-নদীর মাছের চেয়ে অনেক কম হওয়ায় তা অল্প আয়ের মানুষের বাজারের থলেতে জায়গা করে নেয়। বাড়তে থাকে মাছের বাজার। এফএওর চলতি বছরের বৈশ্বিক মৎস্য প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ গত তিন বছরের মতো তৃতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে। একই সঙ্গে মিঠাপানির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ।
জানতে চাইলে মৎস্যসম্পদবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ, বাংলাদেশের ইকো-ফিশ প্রকল্পের দলনেতা অধ্যাপক আবদুল ওহাব প্রথম আলোকে বলেন, নদী দখল ও দূষণের কারণে মাছের পরিমাণ কমে আসছিল। কিন্তু দেশের মৎস্যবিজ্ঞানীদের আবিষ্কার এবং বিদেশ থেকে আসা উন্নত জাতের মাছ দেশের চাষিদের জন্য উপযোগী করে সরবরাহের কাজ করেন মৎস্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারণ কর্মীরা। সর্বোপরি দেশের সাহসী চাষিরা এগিয়ে এসেছেন।
উৎপাদন বেড়েছে, দাম বাড়েনি
কোনো দেশে মাছের উৎপাদন বাড়লেই সে দেশের মানুষের মাছ খাওয়ার পরিমাণ যে বাড়ে, তা নয়। যেমন মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে মাছের উৎপাদন বাড়লেও এসব দেশের মানুষের মাছ খাওয়ার পরিমাণ সেভাবে বাড়েনি। বাংলাদেশে মাছ খাওয়ার পরিমাণ বাড়ার প্রধান কারণ, অল্প আয়ের মানুষদের কাছে জনপ্রিয় ও ক্রয়সীমার মধ্য থাকা মাছগুলোর দাম দীর্ঘদিনেও খুব একটা বাড়েনি। চাষের রুই, পাঙাশ, তেলাপিয়া, কই ও রাজপুঁটির দাম এখনো কেজিপ্রতি দেড় শ থেকে আড়াই শ টাকার মধ্যে।ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) দেশের ছয় ধরনের প্রাণিজ আমিষজাতীয় খাদ্যপণ্যের দাম পর্যবেক্ষণ করে থাকে। সংস্থাটির গত বুধবারের হিসাব অনুযায়ী গত এক বছরে রুই মাছের দাম অপরিবর্তিত আছে। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের হিসাবেও গত ছয় বছরে রুইসহ পাঙাশ, তেলাপিয়া ইত্যাদি মাছের দাম বাড়েনি। বরং নদী থেকে পুকুরে চাষের আওতায় আসা ছোট মাছগুলোর দাম এ সময়ে উল্টো কমেছে। যেমন পাবদা, টেংরা, শিং ও মাগুর মাছ আগের চেয়ে কম দামে পাওয়া যায়।মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বিলুপ্তপ্রায় এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ মাছগুলোর চাষপদ্ধতি এবং জাত উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিচ্ছি।’
পাতে ফিরছে দেশি ছোট মাছ
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, দেশে ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের মধ্যে ৬৪টি বিপন্নপ্রায়। তবে এর মধ্যে ৩১টির উন্নত জাত এবং পুকুরে চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। বিশেষ করে শিং, মাগুর, পাবদা, গুলশা, কই, চিতল ও মহাশোল মাছের পোনা উৎপাদন এবং এসবের চাষ লাভজনক হিসেবে পরিচিতি পায়।পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০০৯-১০ সালে চাষ থেকে দেশীয় ছোট মাছের মোট উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টনে। দেশের প্রায় পাঁচ লাখ মৎস্যচাষি ও উদ্যোক্তা বিলুপ্তপ্রায় এসব মাছ চাষ করছেন। বিজ্ঞানীরা জেনেটিক গবেষণার মাধ্যমে রুই মাছের চতুর্থ প্রজন্মের উন্নত জাত, তেলাপিয়া মাছের ১৩তম প্রজন্ম এবং কই মাছের চতুর্থ প্রজন্ম উদ্ভাবন করেছেন। রুই মাছের নতুন প্রজন্ম স্থানীয় জাতের তুলনায় ২০ থেকে ১২ শতাংশ বেশি উৎপাদনশীল।মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেশি মাছের জিন ব্যাংক গড়ে তুলেছি। সেখান থেকে জনপ্রিয় এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতগুলোর চাষপদ্ধতি উদ্ভাবন করছি।’
সামুদ্রিক মাছ উৎপাদনে নজর দিতে হবে
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ১৯৮৪ সালে দেশে মাছের উৎপাদন ছিল ৮ লাখ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ লাখ ৩ হাজার মেট্রিক টনে। এর মধ্যে ৩৮ লাখ মেট্রিক টনই মিঠাপানির মাছ। যার মধ্যে চাষ থেকে এসেছে ২৫ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন। সমুদ্র থেকে পাওয়া গেছে ৬ লাখ ৭১ হাজার মেট্রিক টন।বর্তমানে দেশে ৬ শতাধিক তেলাপিয়া হ্যাচারি ও ১৫ হাজারের বেশি খামার গড়ে উঠেছে। এসব হ্যাচারি ও খামারে লক্ষাধিক মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে।এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক মো. গোলাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চাষ ও নদীর মাছের উৎপাদনে অনেক সাফল্য পেয়েছি। কিন্তু সমুদ্রের মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা এখনো বেশ পিছিয়ে আছি। আমাদের এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি, কৌশল এবং অবকাঠামোর আরও উন্নয়ন ঘটাতে হবে।’