৭ই মার্চঃ যেদিন থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের🇧🇩🇧🇩🇧🇩
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ইতিহাসের অনন্য ভাষণটি দিয়েছিলেন। মাত্র উনিশ মিনিটের ওই ভাষণে তিনি গোটা বাঙালির প্রাণের সমস্ত আকুতি ঢেলে দিলেন। যা ছিল, অধিকার-বঞ্চিত বাঙালির হাজার বছরের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন পূরণের উচ্চারণে সমৃদ্ধ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ৭ মার্চ এক অত্যুজ্জ্বল মাইলফলক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন তাঁর সর্বশেষ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন এটা ১ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার পরই সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন। যার কারণে ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসভার জন্য সমগ্র পাকিস্তানের সব মানুষ উৎকণ্ঠিত চিত্তে অপেক্ষা করছিলেন। যদিও ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ আয়োজিত সভায় বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। ঐদিনই তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, তাঁকে গ্রেফতার করা হবে। সেজন্যই বঙ্গবন্ধু পল্টনের সভায় উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি যদি নাও থাকি…।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান হয়ে উঠে জনসমুদ্র। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠেই সরাসরি মাইক্রোফোনের কাছে গিয়ে দৃঢ় চিত্তে বলেন; ‘আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি।’ তারপর পাকিস্তানের জন্ম থেকে ঐদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতিতে বাঙালিদের ওপর অবাঙালিদের শোষণ-নির্যাতনের ইতিহাস তুলে ধরেন।
২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নতুন প্রস্তাবিত জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেয়া প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চারটি শর্ত আরোপ করেন; ‘১. সামরিক আইন মার্শাল ল উড্রো করতে হবে।
২. সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।
৩. যেসকল ভাইদের হত্যা করা হয়েছে তার সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে।
৪. আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না! আমার দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিস্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজাদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, সেজন্য… রিকশা, গরুর গাড়ি, রেল-লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তর, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না।’সেই সঙ্গে প্রত্যেক মাসের ২৮ তারিখে গিয়ে কর্মচারিদের বেতন নিয়ে আসতে বলেন। বঙ্গবন্ধু ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। বলেন, ‘রেডিও-টেলিভিশন যদি আমাদের খবর না দেয়, তাহলে কোনো বাঙালি সেখানে যাবেন না।’ বঙ্গবন্ধু ২ ঘন্টা ব্যাংক খোলা রাখার নির্দেশ দেন।
ভাষণের শেষ দুটি বাক্যে বঙ্গবন্ধু বলেন,
‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব’
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব-ইনশাআল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
ঐতিহাসিক ভাষণের এই সর্বশেষ দুটি বাক্য পরবর্তী সময়ে বাঙালির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার চূড়ান্ত সংগ্রামে অমূল্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল এক অনুপম অমর কবিতা। ছন্দোময় সে ভাষণ ছিল প্রাণস্পর্শী। উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ছিল উদ্দীপনাময় অথচ কী আশ্চর্যজনকভাবে সংযত। লাখো মানুষের হৃদয়ে তা অনুরণিত হচ্ছিল-জয় বাংলা ধ্বনিতে আর করতালিতে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বেলিত জনতা তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এই দৃপ্ত ভাষণ সে সময় সারা বাংলার মানুষ, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীগণ ও ইপিআর, পুলিশ এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের কাছে স্বাধীনতার সবুজ সংকেত হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল।
‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা বাঙালির কাছে এক ‘গ্রিন সিগন্যাল’ বলে মনে হলো। কৌশলগত দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের তাৎপর্য ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু সারা পাকিস্তানের মানুষকে এটা দেখাতে সমর্থ হয়েছিলেন যে, সমগ্র পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও সামরিক জান্তা তাঁকে ক্ষমতায় বসতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের প্রথম আক্রমণকারী প্রতিপক্ষ হতে চাননি। বঙ্গবন্ধুর কৌশলের কারণে বিশ্ববাসীর সমর্থন ও সহানুভূতি পেয়েছিল বাঙালিরা। অন্যদিকে পাকিস্তানিরা সমগ্র বিশ্বে খুনি ও লুটেরা হিসেবে নিন্দা এবং ঘৃণা কুড়ায়।পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকায় ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, “৭ মার্চ যখন আমি ঢাকা রেসকোর্স মাঠে আমার শেষ মিটিং করি, ঐ মিটিং-এ উপস্থিত দশ লাখ লোক দাঁড়িয়ে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানকে ‘স্যালুট’ জানায় এবং ঐ সময়ই আমাদের জাতীয় সঙ্গীত চূড়ান্ত রূপে গৃহীত হয়ে যায়।…
আমি জানতাম কী ঘটতে যাচ্ছে, তাই আমি ৭ মার্চ রেসকোর্স মাঠে চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করেছিলাম এটাই স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য যুদ্ধ করার মোক্ষম সময়।…
আমি চেয়েছিলাম, তারাই (পাকিস্তানি সেনাবাহিনী) প্রথম আমাদের আঘাত করুক। আমার জনগণ প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত।” ১৯৭২ সালে ১৮ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টেলিভিশনের ‘ডেভিড ফ্রস্ট প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠনে সাক্ষাৎকারটি সম্প্রচারিত হয়।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে সেদিন পাকিস্তানি জেনারেলদের রণকৌশল মার খেয়েছিল।