করোনাভাইরাস মহামারি
নিয়ন্ত্রণে মাস্ক ব্যবহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। মাস্ক ছাড়া ঘরের
বাইরে বের হলেই দিতে হবে জরিমানা। এই জরিমানা করার ক্ষমতা পাচ্ছে পুলিশ।
একই সঙ্গে টিকা ছাড়া চলাফেরা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ১৮ বছরের বেশি বয়সী
কেউ টিকা ছাড়া রাস্তায় বের হলে পেতে হবে শাস্তি। যদিও ২৫ বছরের কম বয়সী
সাধারণ মানুষের টিকা গ্রহণের জন্য নিবন্ধনের সুযোগই নেই। সেই সঙ্গে চলমান
বিধিনিষেধের মেয়াদ আরও পাঁচ দিন বাড়ানো হয়েছে। ১০ আগস্ট পর্যন্ত বিধিনিষেধ
কার্যকর থাকবে। পরদিন থেকে সারাদেশে দোকানপাট খুলবে, সীমিত পরিসরে
পালাক্রমে যানবাহন চলবে, খুলবে সরকারি-বেসরকারি অফিস।
গতকাল মঙ্গলবার অনলাইনে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকের পর সরকারের দুই মন্ত্রী আ ক
ম মোজাম্মেল হক ও জাহিদ মালেক এসব তথ্য জানান। আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে এ
বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সরকারের ওই প্রজ্ঞাপনে
বিধিনিষেধের বিষয়ে বিস্তারিত বলা হবে বলে জানানো হয়েছে।
বৈঠক সূত্র জানায়, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে
চলতে বাধ্য করা সম্ভব নয়। এ জন্য সবাইকে আগ্রহী করতে হবে। সে জন্য
গ্রামে-গ্রামে, ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে সভা করা হবে। জনপ্রতিনিধিরা সে সভায় অংশ
নেবেন।
এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, ১৮ বছরের বেশি বয়সী সবাইকে আগামী ১০ আগস্টের মধ্যে
টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে কিনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পর্যন্ত যতসংখ্যক
মানুষ টিকার আওতায় এসেছে এবং টিকার যে মজুদ আছে, তা দিয়ে মন্ত্রীর ঘোষিত
সময়ের মধ্যে সবার টিকাকরণ সম্ভব হবে না। ফলে এ ধরনের ঘোষণা কোনো কাজে আসবে
না। আবার অনেকে বলেছেন, মাসের পর মাস কঠোর বিধিনিষেধের কারণে দরিদ্র ও খেটে
খাওয়া মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে সংকট তৈরি হচ্ছে। একই সঙ্গে অর্থনীতির
ওপরও চাপ তৈরি হয়। জীবন-জীবিকার সমন্বয় করতে হলে কঠোর বিধিনিষেধের পরিবর্তে
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এ জন্য
সরকার যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেটি সঠিক। এর কঠোর প্রয়োগের ওপর বাড়তি
গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে সুফল আসবে।
টিকা ছাড়া চলাফেরা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে :করোনা পরিস্থিতি নিয়ে
পর্যালোচনার জন্য গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা কক্ষে
আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠক শেষে
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, স্বাস্থ্য
মন্ত্রণালয় আগামী এক সপ্তাহে এক কোটির বেশি মানুষকে টিকা দেবে। প্রত্যেক
ওয়ার্ডে কমপক্ষে দুটি করে কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হবে। যার ফলে আশা করছি কষ্ট
করে টিকা নেওয়ার পেছনে দৌড়াতে হবে না। প্রায় ১৪ হাজার কেন্দ্রে একসঙ্গে
সপ্তাহব্যাপী টিকাদান কার্যক্রম চলবে। সেখানে বয়স্কদের অগ্রাধিকার দেওয়া
হবে। শ্রমজীবী মানুষ,
দোকানদার, বাসের হেলপারদেরও টিকা দেওয়া হবে।
টিকা ছাড়া রাস্তায় বের হলে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন,
টিকা না নিয়ে কেউ কোনো কর্মস্থলে আসতে পারবেন না। বিধিনিষেধ শিথিল থাকলেও
১৮ বছরের বেশি কেউ টিকা না নিয়ে রাস্তায় বের হতে পারবেন না। হেঁটে হোক অথবা
যে কোনো বাহনেই হোক, কেউ বের হলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে
ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সরকার প্রয়োজনে অধ্যাদেশ জারি করেও শাস্তির
ব্যবস্থা করতে পারে বলে আভাস দেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। তিনি বলেন, যার
যার এলাকা থেকে টিকা নিতে হবে। কেউ টিকা নিয়েছে কিনা, সেই তথ্য ওয়েবসাইটে
চলে যাবে, কেউ মিথ্যা বলতে পারবে না। দোকানপাট খোলার আগে ৭, ৮ ও ৯ আগস্ট
তিন দিন টিকা নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে যাতে টিকা নিতে
পারে, সে সুযোগ দিচ্ছি।
আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, করোনাভাইরাস কতদিন চলবে কেউ জানে না। যত শিগগির
সম্ভব নিজেরা বা অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে টিকা তৈরির চেষ্টা চলছে।
সেটা হলে সবাইকে টিকা দিয়ে দেব। চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে আগামী চার থেকে পাঁচ
মাসের মধ্যে দেশে টিকা উৎপাদন করা যায়। আইসিইউর অভাব রয়েছে। বঙ্গবন্ধু
মেডিকেল কলেজের কনভেনশন সেন্টারে আগামী শনিবার থেকে ডেডিকেডেট করোনা
হাসপাতাল চালু হবে। মন্ত্রী বলেন, করোনার উচ্চ সংক্রমণের মধ্যেও কিছু রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা
খুলে দেওয়া হয়েছে। এগুলো খুলে না দিলে বিশ্ববাজার হারাতে হবে। অর্থনীতিকে
সচল রাখতে এগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে।মাস্ক না পরলে জরিমানা :করোনাভাইরাস মহামারি নিয়ন্ত্রণে মাস্ক ব্যবহার
বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। গতকাল আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী
জাহিদ মালেক বলেন, সবাইকে মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা খুব
গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে সঠিকভাবে এনফোর্স করতে পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন
রয়েছে। যাতে করে যারা মাস্ক পরবে না তাদের জরিমানা করতে পারে। এজন্য
অধ্যাদেশ লাগবে। আলোচনা হয়েছে, আমরা সেদিকেও যাব।স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ৭ আগস্ট থেকে সাত দিনের জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন,
ওয়ার্ডে প্রায় এক কোটি টিকা দেওয়া হবে। সেই টিকা দিতে অনেকের সহযোগিতা
লাগবে। এজন্য সভা করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বাহিনীপ্রধানদের কাছে সেই
সাহায্য চাওয়া হয়েছে। গ্রামের বয়স্ক অর্থাৎ ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের
অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। কারণ তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ।
আমাদের হাতে সোয়া এক কোটির মতো টিকা মুজদ আছে। চলতি মাসে আরও এক কোটি টিকা
এসে পৌঁছাবে। যাদের এনআইডি কার্ড নেই তাদের বিশেষ ব্যবস্থায় টিকা দেওয়া
হবে।টিকা উৎপাদনের প্রস্তুতির কথা জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেশীয়ভাবে
টিকা উৎপাদনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চীনের সিনোফার্মের সঙ্গে আলোচনা অনেক
দূর এগিয়েছে। দ্রুতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে বলে জানান তিনি। কঠোর বিধিনিষেধ বাড়ল পাঁচ দিন :করোনার সংক্রমণ রোধে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া
‘কঠোর’ লকডাউন ১৪ জুলাই পর্যন্ত কার্যকর ছিল। এরপর ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১৫
থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত তা শিথিল করা হয়। পরে ২৩ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত
১৪ দিনের কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ওই বিধিনিষেধের মধ্যেই ১
আগস্ট থেকে রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসে। এরপর
স্বাস্থ্যবিধি ভেঙে লাখ লাখ মানুষ গ্রাম থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন নগরীতে ফিরে
আসেন। এর মধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে আরও ১০ দিন চলমান কঠোর
বিধিনিষেধ কার্যকর করার পরামর্শ দেওয়া হয়। গতকাল আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে
থেকে তা আরও পাঁচ দিন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। মাস্ক ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে, মত বিশেষজ্ঞদের :মাস্ক ব্যবহারে সরকারের
পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন
অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ সমকালকে বলেন, মাস্ক ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত
করা গেলে সংক্রমণ অনেকাংশে কমে আসবে। এ বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ
করেছে, তা ইতিবাচক। তবে এর কঠোর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। মাস্ক না পরলে পুলিশ
জরিমানা করতে পারবে। সেটি যেন যথাযথ প্রক্রিয়ায় হয়। একটি ভালো উদ্যোগ নিয়ে
যাতে বিতর্কিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাহলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে
এটি কার্যকর হবে।
বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে
বলেন, শুরু থেকেই মাস্ক ব্যবহার ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব
দিয়ে আসছি। কিন্তু এটি বাধ্যতামূলক করতে সরকারি উদ্যোগে ঘাটতি ছিল। দরিদ্র
মানুষের জন্য বিনামূল্যে মাস্ক সরবরাহ করতে হবে। একই সঙ্গে সচেতনতামূলক
কর্মকা চালাতে হবে; কিন্তু সেটি হয়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও মাস্ক
ব্যবহার করলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অনেকাংশে কমে আসে- এটি প্রমাণিত।