বিনিয়োগসীমা অর্ধেকে নামানো হচ্ছে
সঞ্চয়পত্রে
ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত
নেয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, প্রবাসীর জন্য বিনিয়োগ বন্ডেও ঊর্ধ্বসীমা
নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। বর্তমানে এই খাতে বিনিয়োগের কোনো ঊর্ধ্বসীমা নেই।
বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা এখন এক কোটি টাকা
নির্ধারণ করা হচ্ছে। আগামী মাসে এ বিষয়ে একটি বিধিমালা জারি করা হবে বলে
জানা গেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের পক্ষ থেকে এই বিধিমালা তৈরি করা হচ্ছে।
জানা গেছে, বর্তমানে পরিবার সঞ্চয়পত্র,
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র এবং পাঁচ বছর মেয়াদি
বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে যেকোনো ব্যক্তি একক নামে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা
বিনিয়োগ করতে পারেন এবং যৌথ নামে বিনিয়োগের সীমা রয়েছে ৪৫ লাখ টাকা।
বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি
বিনিয়োগকারী সঞ্চয়ের তিন স্কিমে ৩০ লাখ টাকা করে মোট ৯০ লাখ টাকা বিনিয়োগ
করতে পারেন। কিন্তু আগামীতে এই তিন স্কিমের বিনিয়োগের পরিমাণ ৫০ লাখ টাকার
বেশি করা যাবে না। অর্থাৎ কেউ তিন মাস মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ
বিনিয়োগসীমা ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে তিনি
অন্য একটি স্কিমে আরো ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন। ফলে এই তিন স্কিমে
সর্বোচ্চ একক নামে ৫০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করা যাবে না।
একইভাবে বর্তমানে যৌথ নামে সঞ্চয়পত্রে
একেকটা স্কিমে ৪৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা যায়। এ ক্ষেত্রে সঞ্চয়ের তিন স্কিমে
৪৫ লাখ করে এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা যেত। আগামীতে এ সীমা কমিয়ে এক
কোটি টাকায় নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে
অনুষ্ঠিত ঋণ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একটি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে
সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছেন।
বৈঠকে বলা হয়, বর্তমানে ওয়েজ আর্নার
ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড এবং ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট
বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো সিলিংস নেই। তাই এ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট
সিলিং থাকা প্রয়োজন রয়েছে। কেননা সরকার প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের
বিপরীতে দুই পার্সেন্ট হারে প্রণোদনা প্রদান করছে। পাশাপাশি এসব বন্ডে
বিনিয়োগের বিপরীতে সরকারকে প্রায় ১৬ শতাংশের ওপর সুদ প্রদান করতে হচ্ছে।
তাই একই ব্যক্তি দু’টি সুবিধা প্রদান করা সমতার নীতির পরিপন্থী।
পরে বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তিনটি
বন্ডের বিপরীতে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করা হবে। বৈঠকে উপস্থিত
ছিলেন এমন এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে গতকাল বলেছেন, এই বৈঠকে দু’টি
সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এর একটি হচ্ছে- পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ
সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং পরিবার সঞ্চয়পত্রের
বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী যাই থাকুক না কেন তিনটি মিলে একক নামে সর্বোচ্চ
৫০ লাখ টাকা অথবা যৌথনামে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করা যাবে।
পাশাপাশি ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিয়িয়াম বন্ড ও ইউএস
ডলার বন্ডের বিপরীতে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা
বিনিয়োগ করা যাবে। এ বিষয়ে জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি
করার কথা বলা হয়।
এ দিকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেও সরকারের
পক্ষে জনগণকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা সম্ভব হচ্ছে
না। ফলে অর্থবছরের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার
করার লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও মাত্র দুই মাসে এ খাত থেকে ৭ হাজার ৪৫৫ কোটি
টাকা নেয়া হয়ে গেছে। অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ
করার যে লক্ষ্য ধরেছিল তার ৩৭ দশমিক ২৭ শতাংশ দুই মাসেই নেয়া হয়ে গেছে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতর সর্বশেষ সে তথ্য
প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, জুলাই-আগস্ট সময়কালে ৭ হাজার ৪৫৫ কোটি ৫ লাখ
টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অঙ্ক গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ের
দ্বিগুণেরও বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ৩ হাজার ৭১২ কোটি ৩৬ লাখ
টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩
হাজার ৫৪৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়। আর আগস্টে নিট
বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭৪৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা, যা এক মাসের হিসাবে গত
দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এর আগে ২০১৯ সালের মার্চে ৪ হাজার ১৩০
কোটি ৭১ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। আর গত বছরের আগস্টে এই
বিক্রির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪৯৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে,
গত বছরের আগস্টের চেয়ে এবার আগস্টে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে ১৫০ শতাংশ।
২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে মোট ১৪ হাজার
৪২৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। এর আগে গত বছর সঞ্চয়পত্র
বিক্রি কমানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে
কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। একই সাথে এক লাখের
বেশি টাকার সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে অবশ্যই তা ব্যাংক চেকের মাধ্যমে কেনার
নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু এরপর সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এ খাতে বিনিয়োগ কোনো
অংশেই কমিয়ে দেননি। কারণ নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের পছন্দের খাত
এটি।
সরকারের এই পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে সঠিকই বলা
যেতে পারে। কারণ অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ব্যয় কমাতে হলে এই পদক্ষেপ নিতে হবে।
তবে দেখতে হবে এই সিদ্ধান্তের ফলে যাদের টাকা আছে তারা তো অতিরিক্ত অর্থ
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে পারবে না। এই অর্থ তারা যেন বিদেশে পাচার না করে।
যেকোনোভাবে হোক না কেন অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি,
এখানে বিনিয়োগও হয় বেশি। সরকারের অভ্যন্তরীণ সুদে ব্যয় বেড়ে যায়। এই ব্যয়
বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকারের প্রাধিকারভুক্ত খাতে ব্যয় সঙ্কোচন করতে হয়। এ
ক্ষেত্রে বাজেট ঘাটতিও বেড়ে যায়। তাই এটি যেটা করেছে তাতে আপত্তির খুব বেশি
কারণ নেই। আর সরকার এমনিতে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিচ্ছে। কারণ এ খাতে
সুদের হার কম। আর করোনার কারণে সরকারের বাজেট ঘাটতিও বেড়ে যাবে। তাই ব্যাংক
থেকে ঋণ নেয়াটাই কাম্য। তাই এ খাতে বিনিয়োগের সীমা কমানোটা খারাপ বলা যাবে
না। আমার মনে হয় ঠিকই আছে।
আর এই সিলিং যারা বিনিয়োগ করতে পারছেন
তারা তো নিম্নবিত্ত নয়, তারা মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত বা বিত্তশালী। তাই
এ সিদ্ধান্ত আমার মনে হয় ঠিকই আছে। একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে যে এতে করে
যেন বিদেশী অর্থ পাচার না হয়ে যায়। কারণ যারা অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে
পারবেন না, তাদের কেউ কেউ হয়তো বিদেশে টাকা পাচার করতে যাবেন। এই পাচারটা
সরকারকে বন্ধ করতে হবে।